ভারতের কাঠ মিস্ত্রীর ছেলের একার ব্যাটিং তান্ডবে বিশ্বকাপের ১ম ম্যাচে ১০ উইকেটে ওমানের জয়

কেতাবি নাম ‘আল–হাজার মাউন্টেনস’—বাংলা অর্থে মনে হতে পারে হাজার পর্বতমালা। হাজারখানেক পর্বত না থাকলেও পূর্ব আরব উপদ্বীপে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ধারণ করছে এ পবর্তমালা।

আল আমেরাত স্টেডিয়াম তারই পাদদেশে অবস্থিত। এখানেই আজ শুরু হচ্ছে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক ওমানের মুখোমুখি হয়েছে পাপুয়া নিউগিনি। রূপক অর্থে দৃশ্যটি যথার্থই—সুপার টুয়েলভের দেশগুলো যদি সেই আল হাজার পর্বতমালার মতো শক্তিশালী হয়, তাহলে শক্তিতে তাদের পদতলে থাকা দুটি দেশের লড়াই দিয়েই শুরু হচ্ছে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

এই ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনিকে ১০ উইকেটে হারিয়েছে স্বাগতিক ওমান। পাপুয়া নিউগিনির দেওয়া ১৩০ রানের সহজ লক্ষ্য কোনো উইকেট না হারিয়ে খুব সহজে ১৩.৪ ওভারে টপকে যায় ওমান।

তবে ওমান ও পাপুয়া নিউগিনির এ ম্যাচ নিয়ে কারও আগ্রহই ছিল না। পরিচিত কোনো তারকা যে নেই! কিন্তু দেখার চোখ থাকলে এ সাধারণ ধারণার ভেতরকার ভুলটা চোখে বিঁধবে।

সুপার টুয়েলভে থাকা টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে যদি সাজানো বাগান মনে হয়, তাহলে সে বাগানের এক কোনায় আগাছার চোখে দেখা বুনো ফুলে তাকানোর সময় কোথায়! ওমানের ওপেনার যতিন্দর সিং যেন সেই বুনো ফুল—ছোট দেশের ছোট তারকা কিন্তু সৌরভে কারও চেয়ে কম যান না!

নেপালের বিপক্ষে গত মাসে যতিন্দর সিং ৬০ বলে সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর সহযোগী দেশগুলোর ক্রিকেট নিয়ে খোঁজখবর রাখা সংবাদকর্মী পিটার ডেলা পেনা টুইট করেন,

‘বিশ্ব ক্রিকেটে যতিন্দর সিংয়ের মতো উন্নতি করা কোনো ব্যাটসম্যান পাওয়া কঠিন। নিজ চেষ্টায় সে নিজেকে উঁচু মানের ওপেনার হিসেবে গড়ে তুলেছে। ১৯ বলে ৫০ করার পথে ৩০ রান তুলেছে এক ওভারে।’

শুধু তাই নয় টি২০ বিশ্বকাপের ১ম ম্যাচেও দেখা গেছে তার উজ্বল ব্যাট। ৪ ছক্কা ও ৭ চারে ৪২ বলে ৭৩ রানে ঝড়ো ইনিংস খেলেছেন তিনি। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ বলেই হয়তো এই ম্যাচের পর যতিন্দরকে নিয়ে অনেকে নড়চড়ে বসতে পারেন।

যতিন্দরের জন্ম ভারতের পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। মা–বাবা পাঞ্জাবি, বাবা পেশায় কাঠমিস্ত্রি। বিরাট কোহলি কিংবা বাবর আজমদের মতো পুরোপুরি পেশাদার ক্রিকেটার যতিন্দর হতে পারেননি।

ওমানের রাজধানী মাসকাটের এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক বিভাগে চাকরির ফাঁকে সময় পেলে তাঁকে দেশের হয়ে ওপেন করতে দেখা যায়। ভারতে জন্ম হলেও ক্রিকেটে তাঁর আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি মাসকাটের ভারতীয় স্কুলে। ওমান অনূর্ধ্ব–১৯ দল হয়ে এখন জাতীয় দলে।

কেভিন পিটারসেনের ‘সুইচ হিট’–এর চেয়ে যতিন্দরের সুইচ হিট কোনো অংশে কম কার্যকর নয়। আরও খোলাসা করে বললে, সুইচ হিটটা যেন তাঁর সহজাত শট।

যতিন্দরকে আরেকটু ভালো করে দেখলে শিখর ধাওয়ানকেও মনে পড়ে। ভারতীয় ওপেনারের মতোই সেঞ্চুরি কিংবা ক্যাচ ধরে ঊরুতে চাটি মেরে ‘থাই ফাইভ’ উদ্‌যাপন করেন যতিন্দর।

১৯৮৯ সালে ভারতে জন্ম নেওয়া যতিন্দরের বাবা গুরমাইল ১৯৭৫ সাল থেকে ওমানে কাজ করেন, তিনি রয়্যাল ওমান পুলিশের কাঠমিস্ত্রি। ১৪ বছর বয়সে ওমানে স্থায়ী হওয়ার আগে ভারতে পাড়ার ক্রিকেট খেলেছেন যতিন্দর।

ওমানে এসে দেখেন সেখানকার খেলাটা একটু আলাদা। ২০১২ সাল পর্যন্তও ওমানে ঘাসের মাঠ দেখেননি যতিন্দর। মরুর মাঠে সিমেন্টের উইকেট। শুরুতে মানিয়ে নিতে সমস্যা হতো।

যতিন্দর অবশ্য বলেছেন, ‘তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়তো ছিল না, কিন্তু ক্রিকেটাররা তো খেলতে পেলেই খুশি!’

এই নিবেদনটুকুই যতিন্দরকে এগিয়ে দিয়েছে। ওমান ক্রিকেটের প্রধান তাঁকে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দেন। যতিন্দর ওমানের আস্থার প্রতিদান কেমন দিচ্ছেন, শুনুন দলীয় অধিনায়ক জিসান মাকসুদের কণ্ঠে, ‘এ মুহূর্তে সে আমাদের দলের সেরা খেলোয়াড়’—অর্থাৎ ‘বড়’দের বাগানের ‘ছোট’, কিন্তু সুগন্ধি বুনো ফুল!

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *